- আব্বু, প্যাকেটটার ভিতর কি আছে বল
না ! অনুনয় করে বলল তমাল ।
- উহু, বলা যাবে না । রাত ১২ টায় কেক
কেটে তারপর প্যাকেটটা যখন তোর
হাতে দিব তখন তুই নিজে খুলে দেখবি ।
তারেক সাহেব বললেন ।
- কেন? এখন বললে কি হবে ?
- এখন বলে দিলে মজাটা থাকবে না ।
আজকে তমালের পঞ্চম জন্মবার্ষিকী ।
প্রতিবারের মত এইবারও পরিবারের চারজন
মিলে জন্মদিন পালন করা হবে । তমালরা দুই
ভাই । তার বড় ভাই তুহিনের বয়স ১১ বছর ।
রাত ১১ টা ৫৯ মিনিট :
জন্মদিনের
কেকে পাঁচটি মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে ।
সবাই অপেক্ষা করছে ১২ টা বাজার জন্য ।
১২ টা বাজার সাথে সাথেই তমাল তার
মায়ের হাতে হাত রেখে কেক কাটল । তার
বাবা - ভাই হাততালি দিল আর উইশ
করলো । তমাল তার বাবা – মা – ভাই
সবাইকে কেক মুখে তুলে দিল । কেক খাওয়ার
পর্ব শেষ হতেই তমাল আলমারির
দিকে এগিয়ে গেল যেখানে তার জন্য
আনা গিফটের প্যাকেটটা রাখা হয়েছে । এই
সময় বাইরে চিৎকার – চেঁচামিচির শব্দ
শুনে কৌতূহলবশত
জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল তমাল ।
সাথে সাথে একটা বুলেট তমালের মাথায়
লাগলো । মাটিতে লুটিয়ে পড়লো তমাল ।
তার বাবা তার জন্য কি গিফট এনেছিল
সেটা অজানাই থেকে গেল তার । চোখের
সামনে এই দৃশ্য দেখে সবাই চিৎকার
করে উঠলো । তারেক সাহেব জানালার
কাছে গিয়ে একটু উঁকি দিয়ে দেখলেন
কয়েকজন
পাকিস্তানী মিলিটারি দৌড়ে বিল্ডিংয়ের
ভিতর ঢুকছে । তার বড় ছেলেকে বাঁচানোর
একটা মাত্র উপায় তার মাথায় আসল ।
তিনি দৌড়ে গিয়ে তুহিনকে ধরে দেয়ালের
দিকে ছুঁড়ে মারলেন । মাথায় প্রচণ্ড আঘাত
পেয়ে তুহিন জ্ঞান হারাল । বেহুঁশ
তুহিনকে টেনে তমালের মৃতদেহের
কাছে ফেলে রাখলেন । কয়েক সেকেন্ড
পরেই বুটের লাথিতে বাসার সদর
দরজা খুলে গেল ।
ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল তুহিন ।
মাথায় প্রচণ্ড ব্যথার
সাথে একটা ঘোলাটে ভাব কাজ করছে।
চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো না সে বাস্তবে আছে নাকি কোন
ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখছে । তার
বাবা মা রক্তাক্ত অবস্থায়
মেঝেতে পড়ে আছে । সে পড়ে আছে তার
ছোট ভাইয়ের রক্তাক্ত লাশের পাশে ।
হতবাক হয়ে সে লাশগুলোর
দিকে তাকিয়ে আছে ।
কীভাবে কি হয়ে গেল কিছুই
বুঝতে পারলো না সে । শুধু বুঝতে পারলো এই
পৃথিবীতে সে পুরোপুরি একা হয়ে গেছে ।
প্রচণ্ড কষ্টে তার বুক দুমড়ে মুষড়ে যাচ্ছে ।
কিন্তু তার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানিও
বের হচ্ছে না । মাত্রাতিরিক্ত
শোকে সে পাথর হয়ে গেছে ।
উঠে দাঁড়িয়ে টলতে টলতে গেট
খুলে বাইরে পা দিল । পাশের বাসার
দরজা হাট করে খোলা ।
খোলা দরজা দিয়ে ভিতরের বীভৎস দৃশ্য
দেখা যাচ্ছে । অজানার
উদ্দেশ্যে যাত্রা করার আগে ঘাড়
ঘুড়িয়ে বাবা – মা – ভাইয়ের লাশের
দিকে তাকাল । তার মাথার
ঘোলাটে ভাবটা কেটে গেছে ।
আপনা আপনি তার হাত মুঠিবদ্ধ হয়ে গেল ।
শোকটা শক্তিতে পরিণত হয়েছে ।
প্রতিশোধের নেশায় তুহিনের
চেহারা ভয়ংকর হিংস্র হয়ে উঠেছে । ১১
বছরের একটা ছেলের চেহারা এতটা ভয়ংকর
রূপ ধারণ করতে পারে না দেখলে কেউ
বিশ্বাস করবে না । কি ভেবে আবার ঘরের
ভিতরে ঢুকল তুহিন। তার পড়ার টেবিলের
উপর থেকে কালো রংপেন্সিল
তুলে নিয়ে দেয়ালে সাঁটানো ক্যালেন্ডারের
সামনে গেল । ২৫ মার্চের তারিখটা ভরাট
করলো ।
এমন সময় দুইজন লোক
হাঁপাতে হাঁপাতে রুমে ঢুকল । দুইজনের
মধ্যে একজনের কপাল
বা পাশে কেটে গেছে ।
- পাকিস্তানীরা আবার
এইদিকে আসতে পারে । তাড়াতাড়ি চল ।
যারা বেঁচে আছে তাদের খুঁজে বের
করতে হবে । তুহিনকে বলল একজন ।
- কালকে রাত থেকে কি হচ্ছে একটু
বলবেন ? তুহিন জিজ্ঞেস করলো ।
- কালকে রাতে পশ্চিম
পাকিস্তানীরা আমাদের দেশ আক্রমণ
করে গণহত্যা শুরু করেছে । আক্রমণের পর
কাল রাতেই রেডিওতে স্বাধীনতার
ঘোষণা করা হয়েছে । আমাদের দেশের নাম
এখন বাংলাদেশ ।
- এখন কথা বলে নষ্ট করার মত সময় নেই।
তাড়াতাড়ি চল । অন্যজন বাধা দিয়ে বলল ।
- তিনতলা আর চারতলায় কেউ
বেঁচে আছে কিনা দেখে আসেন । আমি বের
হচ্ছি। তুহিন বলল ।
লোক দুইজনের পায়ের শব্দ
উপরে চলে গেলে টেবিল থেকে লাল আর
সবুজ রংপেন্সিল তুলে নিল তুহিন । ২৬
তারিখের পাশে লাল রংপেন্সিল দিয়ে বড়
করে লিখল " প্রতিশোধ "।
তার পাশে সবুজ রংপেন্সিল দিয়ে লিখল "
শুভ জন্মদিন বাংলাদেশ " ।
ক্যালেন্ডারটা ছিঁড়ে পকেটে ভরে নিয়ে ঘর
থেকে বের হয়ে আসল তুহিন।
বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ, ২০১৪
সে পড়ে আছে তার ছোট ভাইয়ের রক্তাক্ত লাশের পাশে
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন